আমার গুরু অনুপ সাদি
• আনিসুর রহমান, লেখক ও অধ্যাপক
আমি তাঁকে (অনুপ সাদি Anup Sadi) গুরু বলে ডাকতাম। তাঁকে নিয়ে লিখতে চেয়েছিলাম অনেক আগেই। কিন্তু তা হয়ে ওঠেনি। অন্তরাশ্রম পত্রিকাকে ধন্যবাদ একটি বিশেষ সংখ্যা বের করতে যাচ্ছেন, আমার গুরুকে নিয়ে। আমার লেখার অভ্যাস না থাকলেও এ সুযোগ হাত ছাড়া করলাম না।

২০০৪ সাল। কুষ্টিয়ায় এক চায়ের দোকানে টগবগে এক তরুণের সাথে পরিচয় হয়। লক্ষ্য করছিলাম ঐদিন তিনি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন ইস্যুতে কথা বলছিলেন। অনেকটা মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনছিলাম। পরিচয়ে জানতে পারলাম সদ্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্য নিয়ে পড়াশোনার পাঠ চুকিয়ে কুষ্টিয়ায় Eltip ট্রেইনার অর্থাৎ কুষ্টিয়া জেলার ইংরেজি শিক্ষকদের ট্রেইনার হিসেবে কাজ করছেন।
কুষ্টিয়ায় থাকাকালীন দেখেছিলাম তিনি লিখতে ও বেড়াতে পছন্দ করতেন। সে সময় পৃথিবীর রাষ্ট্রনীতি আর তোমাদের বংশবাতিসহ বেশ কয়েকটি উল্লেখযোগ্য কবিতা গ্রন্থ প্রকাশিত হয়। এরপর বিসিএসে সরকারি কলেজের শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন।
তিনি মনে প্রাণে আধুনিক মানুষ। অফলাইন ও অনলাইনের বিভিন্ন প্লাটফর্মে তিনি তাঁর লেখনীর মাধ্যমে সরব আছেন এখনো। আমি ভেড়ামারা কলেজে এখন কর্মরত আছি। গুগলে ভেড়ামারা কলেজ লিখে সার্চ করলে প্রথমেই উইকিপিডিয়া যে তথ্য দেয়, তা সবার কাছেই গ্রহণযোগ্য। শুনলে আশ্চর্য হবেন, ভেড়ামারা কলেজ নামে উইকিপিডিয়ায় প্রথম পাতা খুলেছিলেন যিনি, একই সাথে ভেড়ামারা কলেজকে যিনি জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে পরিচয় করিয়েছিলেন, তিনি আমার গুরু–অনুপ সাদি।
শুধু ভেড়ামারা কলেজ নয়, এমন হাজার হাজার প্রতিষ্ঠান ও ইভেন্ট আছে গুগলে যা অনুপ সাদির মাধ্যমে চেনা হয়। মজার ও অবিশ্বাসের ঘটনা হলো, গুরুকে প্রথম দর্শনে দেখে বোঝার উপায় নাই, তিনি কেমন, কোন মানসিকতার? তিনি নিজেকে প্রকাশ করতে কম পছন্দ করেন। তিনি কীভাবে যে এই জায়গায় নিজেকে চাপা দিয়ে রাখেন, তা আমার কাছে আজও গবেষণার বিষয়?
কুষ্টিয়ায় থাকাকালীন প্রায়ই গড়াই নদীর তীরে যেতাম গড়াই নদীর ঢেউয়ের তরঙ্গশীর্ষের উঠানামা দেখতে। মাঝে মাঝে সাদি ভায়ের সাথে নদীর ওপারে বিস্তীর্ণ বালুরাশির মধ্যে চলে যেতাম। সূর্য দেবতা পাটে অস্ত যাবার পর সন্ধ্যার আকাশে যে নীলিমা তৈরি হতো, তা দেখতাম খুব মনোযোগ দিয়ে। এমনি করে মাঝে মাঝে শিলাইদহ কুঠিবাড়ী কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছোঁয়া নিতে যেতাম আমার গুরুর সাথে। সেখান থেকে পদ্মার পাড়, রবি ঠাকুরের কাছারি বাড়ি কোনো কিছুই বাদ থাকতো না। এগুলো দেখার পর চলত আলোচনা-সমালোচনা। মজার ও সত্যি ঘটনা হলো, আমি কুষ্টিয়ার ছেলে হলেও কাঙ্গাল হরিনাথের প্রেস প্রথম দেখেছিলাম সাদি ভায়ের সাথে–সেদিনের ঘটনা আজও জ্বাজ্বল্যমান।
আমার দিব্যি মনে আছে কাঙ্গাল হরিনাথের বাড়ি দর্শনের পর সাদি ভাই কুমারখালি শহরের মধ্যে এক শিক্ষিকার বাড়ি নিয়ে গিয়েছিলেন। যিনি আমাদের খুব আপ্যায়ন করেছিলেন। সাদি ভায়ের সাথে এই শিক্ষিকার পরিচয়ের হেতু ছিল শিক্ষিকা ইংরেজি বিষয়ে ট্রেনিং নিয়েছিলেন সাদি ভায়ের কাছে। ঐদিন বুঝেছিলাম সাদি ভাই খুব ভালো মানের ট্রেইনার। যিনি ট্রেইনিদের মনে দাগ কেটেছেন। এমন অনেক ঘটনা আছে যা বলে শেষ করা কঠিন হবে।
সাদি ভাই যখন ময়মনসিংহের গফরগাঁও সরকারি কলেজে ইংরেজি বিষয়ে পড়াতেন তখন একবার গিয়েছিলাম গফরগাঁও। সহকর্মী ও স্থানীয়দের মধ্যে তাঁর অসম্ভব প্রভাব লক্ষ্য করেছিলাম। শিক্ষার্থীদের নিকট একজন আইডল শিক্ষক হিসেবে দেখেছিলাম।
কুষ্টিয়া থাকাকালীন তাঁর লেখার হাতের প্রশংসা না করে উপায় নাই। তরুণ বয়সের কবিতাগুলো ঐ সময় ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়। তিনি একজন পাখি প্রেমী মানুষ। বাংলাদেশের হারিয়ে যাওয়া পাখি নিয়ে তিনি গবেষণাধর্মী লেখা প্রকাশ করেছেন সে সময়ই।
আমি পূর্বেই বলেছি, তিনি খুব আধুনিক মানুষ। আসলে যিনি আধুনিক তাঁর কাজে-কর্মে আধুনিকতার ছোঁয়া থাকে। তিনি দুইটি ওয়েবসাইট ও একটি ইউটিউব চ্যানেল পরিচালনা করেন। এই তিন প্লাটফর্মে তাঁর হাজার হাজার কন্টেন্ট রয়েছে। এ বিষয়ে একটু না বললেই নয়। তিনি পরিচালনা করেন roddure.com নামে একটি ওয়েবসাইট। তিনি এই সাইটে শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি, জাতীয়, আন্তর্জাতিক রাজনীতির বিশ্লেষণ, প্রকৃতি, প্রাণ, পরিবেশ ও জীবনশৈলি নিয়ে ধারাবাহিক লিখে থাকেন। যা বাংলাদেশ, ভারতসহ বেশ কয়েকটি দেশের নাগরিক নিয়মিত ভিজিট করে থাকেন এই ওয়েবসাইট।
তাঁর আরেকটি ওয়েবসাইট হলো, fulkibaz.com। এটি বিভিন্ন খ্যাতনামা লেখকসহ মনীষীদের জীবনীর জন্য বিখ্যাত ব্লগ সাইট। এই সাইটে তিনি সাহিত্য ছাড়াও ইতিহাস, দর্শন, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, অর্থশাস্ত্রের জটিল বিষয়গুলো সহজ ও সাবলীল ভাবে উপস্থাপন করে থাকেন। ক্লাসিক চলচ্চিত্র নিয়ে রিভিউ লিখে থাকেন এই সাইটে। আপনাদের সকলের জানা উচিৎ, আপনারা হয়ত জানেন একটি ওয়েবসাইট পরিচালনা করতে গেলে বেশ কিছু জিনিস জানতে হয়। যারা কম্পিউটার সায়েন্সে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়েন, তারা এগুলো খুব ভাল জানেন। যেমন ওয়েব ডোমেইন রেজিস্ট্রেশন, ডোমেইন হোস্টিং, সার্ভার, ক্লায়েন্ট ম্যানেজমেন্ট, লোড টাইম রিডিউস, ওয়েব সিকিউরিটি, কন্টেন্ট আপলোড, ইউজার ফ্রেন্ডলি, এসইওসহ নানান বিষয়। আপনি শুনে অবাক হবেন, অনুপ সাদি এই কাজগুলো সম্পূর্ণ একাই করে থাকেন। মনে করা যেতে পারে তিনি ইংরেজি সাহিত্যের পাশাপাশি ওয়েব ইঞ্জিনিয়ারিংকেও আয়ত্ত¡ করেছেন অসাধারণভাবে।
Roddure নামে তাঁর একটি ইউটিউব চ্যানেল রয়েছে যেখানে তিনি নিয়মিত কন্টেন্ট আপলোড করে থাকেন। এই ইউটিউব চ্যানেলে শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি ও রাজনীতির সমসাময়িক বিষয়গুলো তুলে ধরার চেষ্টা করেন। ইউটিউবের ভিডিও এডিটিং এর কাজ খুব দক্ষতার সাথেই তিনি করে থাকেন। একইসাথে ইউটিউবে আপলোডের কাজ তিনি নিজেই করে থাকেন। শুধু তাই নয়। আপনি যদি কোনো ভিডিও ইউটিউবে সরাসরি আপলোড করেন তা অন্য কেউ খুঁজে পাবে না। ইউটিউবের সার্চ অপশন কিছু নিয়ম মেনে চলে যা ইউটিউবের আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। বিষয়টি এমন ধরুন, আপনার ফোন থেকে আপনি ইউটিউবে গেলেন, ইউটিউবে যাওয়ার পর ইউটিউবের হোমপেজে যে ভিডিওগুলো দেখা যাবে, আপনার মানসিকতা বা আগ্রহের ভিডিওগুলোই আপনাকে ইউটিউব দেখাবে।
ইউটিউব তার বট দ্বারা আপনার আগ্রহের জায়গাগুলো নিখুঁতভাবে বুঝতে পারে। আপনি যদি খবর দেখতে পছন্দ করেন তাহলে নতুন নতুন খবর এসে থাকবে আপনার ইউটিউব হোমপেইজে। আর আপনি যদি টক শো টাইপের ভিডিও বেশি দেখতে অভ্যস্ত হোন তাহলে আপনার সামনে সেগুলোই আনবে। আপনি যদি লোক গান শুনতে পছন্দ করে থাকেন তাহলে আপনার ইউটিউব হোম পেইজে সেগুলোই এসে থাকবে। কেননা, আপনার পছন্দের ভিডিও না আনলে তো আপনি এখানে সময় কাটাতে চাইবেন না। এই ভিডিওগুলো ইউটিউবের আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স বুঝতে পারে ভিডিওটিতে কী ধরনের কিওয়ার্ড ব্যবহার করা হয়েছে, কী শিরোনাম ব্যবহার করা হয়েছে, কন্টেন্টটি কাদের উপযোগী–ইত্যাদি বিষয় দ্বারা। ভিডিও আপলোডের সময় এই নানান বিষয়গুলো খেয়াল রাখতে হয় ও আলোকপাত করতে হয়, রিভিউ করতে হয়। মজার বিষয় হলো সাদি ভাই এগুলোতেও এক্সপার্ট।
অনেক আগে ইউনেস্কোর একটা লেখায় পড়েছিলাম একুশ শতকের শিক্ষক হতে গেলে তেত্রিশটি শিক্ষক যোগ্যতা থাকতে হবে। এই তেত্রিশটি যোগ্যতাই প্রযুক্তি নির্ভর। যেমন ধরুন, পাওয়ার পয়েন্ট পরিচালনা, ফটোশপ, এক্সেল, ইউটিউবিং, ব্লগিং, গুগল ড্রাইভ, গুগল মিট, জুম অপারেট এগুলো প্রধান দক্ষতা। সাদি ভায়ের এসব যোগ্যতার সবগুলোই আছে। ৩৩টি দক্ষতার মধ্যে বলা হয়েছে কমিউনিকেশন বা যোগাযোগ দক্ষতা অন্যতম। যদি কোনো ব্যক্তির যোগাযোগ দক্ষতা না থাকে তাহলে কোনো দক্ষতাই কাজে লাগানো যাবে না। আসলে যোগাযোগ দক্ষতাই সব দক্ষতার সাথে সেতুবন্ধন তৈরি করে। অনুপ সাদি এই প্রযুক্তি দক্ষতার সাথে যোগাযোগ দক্ষতার সমন্বয় করেন খুব সূচারুরূপে। শুধু তাই নয় তিনি উইকিপিডিয়া ও উইকিমিডিয়ার সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। উইকিপিডিয়াকে নানান ভাবে সমৃদ্ধ করে যাচ্ছেন প্রতি মূহুর্তে। তিনি উইকিপিডিয়া ও উইকিমিডিয়া বিষয়ে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বেশ কয়েকটি সেমিনারে অংশগ্রহণ করেছেন। সাদি ভাই আপনি আছেন আমাদের হৃদয়ে।
২৫-২৯ সেপ্টেম্বর ২০২২,
ভেড়ামারা, কুষ্টিয়া, বাংলাদেশ।
বিশেষ দ্রষ্টব্য: অনুপ সাদি সম্পর্কিত এই মূল্যায়নটি এনামূল হক পলাশ সম্পাদিত সাহিত্যের ছোট কাগজ অন্তরাশ্রম-এর অনুপ সাদি সংখ্যা, সংখ্যা ৪, পৃষ্ঠা ২৮-৩০, ময়মনসিংহ থেকে ৩০ নভেম্বর ২০২২ তারিখে প্রকাশিত এবং সেখান থেকে ফুলকিবাজ.কমে প্রকাশ করা হলো।